শ্রীকুমার ব্যানার্জি
( রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক )
হাই প্রোফাইল ম্যাচ খেলা হবে স্লোগান ‘ম’-‘ম’ করেছে। দুশো প্লাসে বাজার গরম। দিল্লি থেকে কলকাতা মনে হয় – শিয়ালদা থেকে সোদপুর ডেইলি প্যাসেঞ্জার – লোকালে ঠাসাঠাসি । কে নেই প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ছোটো, বড়ো, মেজ, নাম না-জানা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, দলের ভোট বিশারদ থেকে জাতীয় সভাপতি। সবাই চায় দলের জয়ের দলিলে নিজের ফিঙ্গার প্রিন্ট। ২০১৯ এর সাফল্য বিজেপি নেতৃত্বকে বিশ্বাস করতে শেখালো বাংলা তৈরি দু-হাত দিয়ে বিজেপিকে আলিঙ্গন করতে। সেরকম কিছু না করেই যখন ১৮টা সিট যা বিধানসভা হিসাবে ১২১। তখন একটু চেষ্টা করলে বাংলা দখল শুধু সময়ের অপেক্ষা । শুধুমাত্র ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ কে ভাঙিয়ে যদি আধা, তাহলে তো আরো ভাঙাতে পারলে ‘উনিশে হাফ একুশে হাফ’। যে রকম ভাবনা সে রকম কাজ। কোমর বেঁধে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, সৈন্য সামন্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া , এক ছোবলেই ছবি।সমস্যা তৈরি হলো, বিজেপি তৈরি কিন্থু বাংলা কি তৈরি, এই প্রশ্ন নিয়ে চর্চা হলোনা। বাংলা কি চায় এটা বোঝার মতন মানসিকতা ও যথেষ্ট সময় ছিল না কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে। বাংলা কি ‘গো – বলয় এর ’ সংস্কৃতি চায়, লাভ জোহাদ চায় , নাকি বাংলা নিজের বাংলাকে চায়। বাংলার মনন না বুঝে কয়েক মাস ধরে ‘বর্গী’ হানা চললো। এটা ঠিকই বাংলার মানুষ অনেক বেশি ধার্মিক কিন্থু গোঁড়া নয়। পাড়ার মোড়ে মোড়ে শনি মন্দির। কারনে অকারণে পথ চলতে চলতে, ট্রেনে-বাসে কপালে হাত ঠেকায়, সে রাস্তার ধারে সিঁদুর মাখা নুড়ি পাথর হোগ বা ব্রীজ দক্ষিণেশ্বর মন্দির ছুঁয়ে যাচ্ছে এই মানসিকতা থেকে। বাঙালীর বারোমাসে তেরো পার্বণ পালন করে ঠিকই কিন্ত ধর্মীয় বিবাধ ও বিদ্ধেষে মন নেই। পঞ্চাননের চরণামৃত খায় আবার মাজারে চাদরও জড়ায়। হিন্দু-বাঙালীর মনের ধার্মিক দিকটা দেখে বিজেপি উৎসাহিত হলো, অন্য দিকে অসাম্প্রদায়িক দিকটা যে আরও গুরুত্বপূর্ণ সেই দিকটা উপেক্ষিত হলো। সমস্যা তৈরি হলো এখান থেকেই।বিজেপি অনুসন্ধানের উঠে এলো বাংলার মানুষ তৃণমূলের বিকল্প চাইছে। উৎসাহিত হয়ে নেতা ভাঙাতে শুরু করলো । বড়ো, মেজো , সেজো , নারদা, সারদা, স্থানীয় চাল চোর থেকে কাটমানি খাওয়া সবাই স্বাগত । দলকে বড় করতে গেলে তৃণমূলকে ভাঙতে হবে – কম পরিশ্রমে অধিক মুনাফা। প্রথম থেকেই খেলাটা উচ্চতারে বেঁধে দিলো। চারদিকে হল্লোর ছড়িয়ে দেওয়া হলো মিডিয়ার মাধ্যমে তৃণমূল শেষ। সবাই তৃণমূল ছেড়ে দিচ্ছে, ফুটো নৌকার সওয়ারি হতে কেউ চাইছে না। ছিপ দিয়ে মাছ তুলতে সময় লাগবে বুঝে খেপলা জাল ফেলে দিলো তৃণমূলের পুকুরে ।বিজেপির স্টেজে আলো করে প্রথম সারিতে তৃণমূলের পরিচিত মুখ, পাশে উজ্জ্বল মুখে এক গাল দাড়ি নিয়ে শুভ্রবসনে মোদি সাহেব , একালের রবীন্দ্রনাথ। স্টেজের এককোনে শুকনো মুখে হাতে দলীয় পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদি ও অকৃত্রিম দিলীপ ঘোষ যেন হারাধনের শেষ ছেলে।
মমতা ব্যানার্জির চেনা পিছে মোদী-অমিত জুটি খেলাটাকে হাই পিছে তুলে নিল। প্রথম ওভার থেকেই বাউন্সার দিতে শুরু করলো. ভাবলো মমতা ভয়ে কুকড়ে যাবে. একবারও বোঝার চেষ্টা করলো না মমতার ডিএনএতে ভগবান ‘ভয়’ ঢোকাতে ভুলে গেছে। মমতা রাস্তায় নামলে যে কি ভয়ংকর সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে জ্যোতি-বিমান-বুদ্ধরা. মোদি-অমিত অহংকারে সেটা শুধু উপেক্ষা করলো তা নয় উপেক্ষিত হলো. ফাস্ট পিছে মমতা অনেক সাবলীল. খেলা জমিয়ে দিল. ভাড়া করা সৈনিক নিয়ে খেলা যায় কিন্তু বড় টুর্নামেন্ট জেতা যায় না এই সহজ-সরল তথ্য আরএসএস-এর বিশ্বাসের ভিত্তি হলেও বাংলার ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রমী হয়ে উঠলো।
প্রশ্ন উঠতে লাগলো খেলাটা এত হাই প্রোফাইলে তুলে নিয়ে গেল কেন মোদি-অমিত জুটি? মাটি কামড়ে বসে থেকে একটা রাজ্যের নির্বাচনকে জাতীয় স্তরের এত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলল কেন? কেন হিসাব না কষেই নাকি এটা সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত এক ভাবনা. ভাবার কোন কারণ নেই যে এটা একটা তাৎক্ষণিক এবং আবেগ জড়িত সিদ্ধান্ত।
ওদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বাংলা দখল করতে পারলে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা যাবে. দলের ভিতরে ও বাইরে. দলের ভেতরে অমিত ও মোদির বিরুদ্ধে ছাই চাপা আসন্তোষ চাপা দেওয়া যাবে এবং অমিত মোদী জুটি অপ্রতিরোধ্য এটা প্রতিষ্ঠা পাবে. বাংলা যেহেতু রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং শিক্ষিত তাই বাংলার মানুষের আশীর্বাদ হিন্দুত্ববাদ ও একদলীয় শাসন, এক জাতি এক দেশ এবং এক আইনের ধারণা ভারতে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দেওয়া হবে।
গোয়েবলস থিওরি প্রথমে মানুষ খুব খায়। গোগ্রাসে খায় বাদ বিচার না করেই, সঙ্গে টাটকা ভিডিও থাকলে তো আর কথাই নেই। বিজেপি অমিত মালব্য কে মাথায় রেখে নিরন্তর ভাবেই কাজ করে চলল। প্রথম প্রথম আশানুরূপ ফল আসতে শুরু করলো উৎসাহিত হয়ে আরো বেশি বেশি ফেক ভিডিও আপলোড করতে শুরু করল। অতিরিক্ত ব্যবহারে বদহজম শুরু হয়ে গেল. আস্তে আস্তে ফেক ভিডিও যে ভোজপুরি সিনেমার অংশবিশেষ, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ছবি, নকল ফেজ টুপি পড়ে রেলে আগুন- মানুষ বুঝতে পেরে গেল। মানুষ আস্তে আস্তে দূরত্ব তৈরি করল মিথ্যার বেসাতি থেকে। সমস্যা তৈরি হল আসল ভিডিও মানুষের আস্থা হারালো-এ যেন রাখালের পালে বাঘ পড়ার গল্প ।
তৃণমূল থেকে নেতা ভাগিয়ে দিয়ে কি লাভ হল? নিজের নেতাকর্মীদের ওপর আস্থা রাখা গেল না কেন?তৃণমূলের চতুর্থ শ্রেণি নেতাদের বিশেষ বিমান সফর, বিজেপি নেতৃত্ব কে আরো বেয়াব্রু করে তুললো। বিশেষ করে শুভেন্দুর ভাঙিয়ে কি লাভ হলো, শুধুমাত্র ভাইপো চোর আর মমতাকে বেগম বলা ছাড়া। ভাইপো কে চোর একথা বিজেপির তো সবাই বলেছে। মমতাকে বেগম বলাতে আখেরে লাভ হলো তৃণমূলের। মুসলিম ভোট আরো বেশি করে সংগঠিতো হলো।হিন্দু ভোট তৃণমূলের দিকে চলতে শুরু করল।
মমতার এক অসাধারণ চাল নিজেকে নন্দীগ্রামের প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা।সমস্ত বিজেপি নেতৃত্বকে নন্দীগ্রামে আটকে রাখলো । মমতার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ভাবল, মমতাকে হারাতে পারলেই নবান্নে বিজেপি । শুভেন্দু ও তার সাঙ্গোপঙ্গ বিজেপি তে যাওয়ায় নারোদা-সারদা আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেলো।
আদি বিজেপির স্থানীয় মন্ডল কর্মকর্তা কলমচির চোখ খুলে দিলো এবং তার মৌলিক ভাবনা ভাগ করে নিল।মনে হয় এটাই বিজেপির হারের কারণ অনুসন্ধানের হক কথার এক কথা। অল্প শিক্ষিত আদি বিজেপির স্থানীয় নেতা হারের পর দুঃখ করে বলেছিল বাংলায় মমতা দুর্গা পুজো করতে দেয় না সরস্বতী পুজো হয় না বা টিউশন করে মেয়ে রাতে ঘরে ফিরলে গণধর্ষণ হয় – এই প্রচার মানুষ বিশ্বাস করেনি।ঘরের বৌমার প্রশ্নে প্রশ্নের মুখে মাথা হেঁট হয়ে গেছে। কেন মানুষ ভোট দেবে। কে বোঝাবে, ভিনদেশীর নেতাদের এটা বাংলা, উত্তরপ্রদেশ নয়। এর চেয়ে স্থানীয় স্তরে দুর্নীতির কথা বললে মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে মেলাতে পারতো। ভোটের বাক্সে তার প্রভাব পড়তো ।
এই ভোটে সিপিএম কংগ্রেস বুঝতেই পারল না কে কার শত্রু। যতটুকু বুঝল তার থেকে সারবত্তা তুলে আনলে আনতে পারল না।দুজনেই সমান শত্রু বিমান বাবুর এই উক্তি অধীরের মাথা ঘুরে কমরেড দের মুখে মুখে ফিরল। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ এর তত্ত্ব ঠিক করে দিলেন। এই খেলায় দুটো দিক কারণ মুদ্রার তিন দিক থাকে না।একদিকে বিজেপি অন্যদিকে তৃণমূল, তাহলে সিপিএম জোটের স্থান কোথায়?কমিউনিস্ট লিবারেশন এর দীপঙ্কর বাবুর মত বিমান বাবুরা বলতে পারলেন না দেশের ও দশের সবচেয়ে বড় বিপদ বিজেপি, তাই লড়াইটা শুরু হোক বাংলা থেকে। বিজেপিকে কে বা কারা বাংলায় এনেছে, কে লালিত-পালিত করেছে এই বিতর্কে আটকে রইল সিপিএম। বোঝার চেষ্টা করল না ঘরে আগুন লাগলে আগে আগুন নেভাতে হয় এবং অন্যকে সাহায্য করতে হয়, সে শত্রু পক্ষও হতে পারে।আগুন নিভিয়ে তারপর আগুন লাগানোর কারণ অনুসন্ধান করতে হয়। বামপন্থী মানুষেরা যেটা জোর গলায় বলতে পারলো, সেটা বামপন্থী জোট বলতে পারল না।
বিমান অধীর বাবুরা ভাবের ঘরে চুরি করতে গিয়ে এ কুল ও কুল দু কুল হারালো।
গোদের ওপর বিষফোঁড়া ISF নামক এক মুসলিম উগ্র মৌলবাদের সাথে গাঁটছড়া।ব্রিগেডে সেলিম সাহেব জামাই আদর করে ভাইজন কে বুকে জড়িয়ে নিলেন । জ্যোতিবাবু ছাড়া বামফ্রন্টের ব্রিগেড এত বড় সম্মান কেউ পাইনি। টুম্পার ব্রিগেডে বামপন্থীদের চোখে জল. ISF যদি কারুর সুবিধা করে সেটা বিজেপির। মুসলিম ভোট ভাগ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বিজেপি। তাই মানুষের কাছে স্পষ্ট বার্তা গেলো এই জোট তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির পক্ষে । বামপন্থী মানুষের এতদিনে সযত্নে রক্ষিত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধ মনোভাব আঘাত এলো, এ কোন বামপন্থা? জাতও গেলো ভোট ও গেলো – যার নিটফল শূন্য আসন । ভাইজানকে জড়িয়ে ধরা সেলিমের হাসি হাসি মুখের ছবি প্রতীকী হয়ে রয়ে গেল।